সরকারি কাজে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বৈধ আদেশ অমান্য করার মতো অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হলে ৩১ কার্যদিবসের মধ্যে শাস্তি দিতে পারবে সরকার। শাস্তির মধ্যে আছে চাকরি থেকে বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর, বেতন কমানো ও নিম্ন পদে পদাবনতি। এমন বিধান রেখে ‘সরকারি চাকরি (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০২৫’ জারি করেছে সরকার। বুধবার মধ্যরাতে এ সংক্রান্ত অধ্যাদেশ জারির আগে অধ্যাদেশটির প্রথম সংশোধন জারি করা হয়েছিল গত ২২ মে। ওই সংশোধনে আট দিনের নোটিশে তদন্ত ছাড়াই দোষী সাব্যস্ত যে কোনো কর্মচারীকে চাকরিচ্যুতিসহ অন্যান্য বিধান রাখা হয়েছিল। তখন অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন সচিবালয়ের কর্মচারীরা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাদেশটি সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এই নিয়ে ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’কে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিন মাসের ব্যবধানে দুইবার সংশোধন করল। গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে পেশাগত দ্বন্দ্ব, কিছু কর্মচারীর কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের রুমে হাতাহাতি, সচিবদের রুম আটকিয়ে আন্দোলনসহ বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এমন উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানা গেছে। এর মাধ্যমে ২০১৮ সালে বাতিল হয়ে যাওয়া ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯’ এর কঠোর বিধান ভিন্ন আঙ্গিকে ফেরত এলো।
৩১ কার্যদিবসে শাস্তি: সংশোধিত অধ্যাদেশে অভিযোগ ওঠা কর্মচারীকে প্রথমে সাত কর্ম দিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। অভিযুক্ত কর্মচারীর জবাব সন্তোষজনক না হলে বা নির্ধারিত সময়ে কারণ না দর্শালে কর্তৃপক্ষ তিন কার্যদিবসের মধ্যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করবে। সংশ্লিষ্ট কমিটিকে তদন্তের আদেশ পাওয়ার ১৪ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। তবে কোনো কারণে তদন্তের সময় বৃদ্ধি প্রয়োজন হলে তা সর্বোচ্চ সাত কার্যদিবস বাড়ানো যাবে। আর যদি কোনো তদন্ত কমিটি উল্লিখিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে না পারে, সেক্ষেত্রে নতুন কমিটি গঠন করার সুযোগ রাখা হয়েছে। যে তদন্ত কমিটি নির্ধারিত সময়ে যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হবে, সেই কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা দায়েরের বিধান রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে এ কারণে প্রাপ্ত শাস্তি সংশ্লিষ্ট অফিসারের এসিআরে যুক্ত করার বিধানও অধ্যাদেশে রাখা হয়েছে। তবে বিদ্যমান পদ্ধতিকে কোনো সরাকরি কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে শাস্তি দিতে হলে বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে দিতে হয়। তবে বিভাগীয় মামলার শেষ করার নির্দিষ্ট কোনো সমসয় সীমা নেই। এ কারণে বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয় না। আবার হলে তা দিনের পর দিন ঝুলে থাকে।
বাদ পড়েছে ‘অনানুগত্য’ শব্দ: গত ২২ মে জারি করা প্রথম সংশোধন অধ্যাদেশে ‘অনানুগত্য’ এর কারণে যে কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ ছিল। এ নিয়ে কর্মচারীদের সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল। দ্বিতীয় সংশোধনে ‘অনানুগত্য’ শব্দটি তুলে দিয়ে ‘সরকারের বৈধ আদেশ’ যুক্ত করা হয়েছে। প্রথম অধ্যাদেশে চার ধরণের শাস্তি ছিল, কিন্তু দ্বিতীয় সংশোধিত অধ্যাদেশে তিন ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। সর্বশেষ অধ্যাদেশের ৩৭ এর (ক) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারী যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বৈধ আদেশ অমান্য করেন, আইনসঙ্গত কারণ ছাড়া সরকারের কোনো আদেশ, পরিপত্র ও নির্দেশ অমান্য করেন বা এর বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করেন বা এসব কাজে অন্য কোনো সরকারি কর্মচারীকে প্ররোচিত করেন, তাহলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। এছাড়া ছুটি বা যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছাড়া অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে সমবেতভাবে নিজ কর্মে উপস্থিত না থাকেন বা অন্য কোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কাজে উপস্থিত হতে বাধা দেন, তাহলে সেটা ‘সরকারি কাজে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী অসদাচরণ’ গণ্য করে সরকার শাস্তি দিতে পারবে। এসব অপরাধের জন্য তিন ধরণের শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। প্রথমত, নিম্নপদ বা নিম্নবেতন গ্রেডে অবনমিত করা। দ্বিতীয়ত, বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া। তৃতীয়ত, চাকরি থেকে বরখাস্ত। প্রথম সংশোধিত অধ্যাদেশে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি ছিল, দ্বিতীয় সংশোধনে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। অভিযুক্ত নারী হলে তদন্ত কমিটিতে একজন নারী সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে আগের অধ্যাদেশের মতো রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ দ্বিতীয় সংশোধনে রাখা হয়নি। অধ্যাদেশের ৩৭(ক)(১১) তে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। তবে দণ্ড আরোপের আদেশ পুনর্র্বিবেচনার জন্য ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে রিভিউ করা যাবে।
উল্লেখ্য, অধ্যাদেশটির প্রথম সংশোধনের প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে এটিকে ‘কালো আইন’ দাবি করে আন্দোলনে নেমেছিলেন সচিবালয়ের কর্মচারীরা। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে সচিবদের একটি পাঁচ সদস্যের কমিটি কর্মচারী নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। এরপর ৪ জুন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের নেতৃত্বে একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি আন্দোলনরত কর্মচারীদের সংগঠনগুলোর কাছ থেকে তাদের আপত্তির বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে অধ্যাদেশটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ৩ জুলাই উপদেষ্টা পরিষদ সংশোধিত সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ অনুমোদন করে, যেটি বুধবার অধ্যাদেশ আকারে জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

চাকরি আইন সংশোধন, ৩১ কার্যদিবসে শাস্তি দিতে পারবে সরকার
সরকারি কর্মচারীরা আন্দোলনে নামলে বাধ্যতামূলক অবসর
- আপলোড সময় : ২৫-০৭-২০২৫ ০২:৫০:৫৭ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৫-০৭-২০২৫ ০২:৫০:৫৭ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ